ব্যাকড্রপঃ
আমার প্রথম সিগারেট খাওয়া ২০১১ সালে, আমি ছোটবেলা থেকেই সিগারেট জিনিষটা অনেক অপছন্দ করতাম, স্কুলে থাকতে একদিন অনেক শখ করে এক বার সিগারেট এ টান দিলেও একদমই সহ্য হয় নাই। এর পরে কলেজ এ উঠলাম, একদিন বেশ বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভ করছিলাম, হঠাৎ পাশে থাকা বন্ধু বলল, “দোস্ত বিড়ি খাবো, একটু সাইড কর।”, মনে হল এমন একটা অখাদ্য খাবার কি আছে, আমি তাকে দেখায় দিব যে এইটা খাবার মধ্যে কোন আনন্দ নাই, তখন তাকে বললাম, “দে আমাকেও একটা দে।” সেই যে বেনসনে টান দিলাম, আমার তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার মত অবস্থা, কিন্তু সে শিখায় দিল, কেমন করে টানতে হয়, কেমন করে ধরে রাখা লাগে, ইত্যাদি। শিখে পড়ে আমিও অনেক কষ্ট করে টান দিলাম, স্বাদ গন্ধ জঘন্য হলেও নিজেকে অনেকটা হিরো হিরো মনে হচ্ছিল এমন একটা জিনিষ খেতে পারি মনে করে।
এর পরে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম, একা একা থাকা শুরু করলাম। ক্লাশের ফাঁকে ফাঁকে যখন যেদিকেই তাকাতাম দেখতাম বেশিরভাগ বন্ধুই সিগারেট খাচ্ছে, দেখে মনে হতে লাগল যে কি আছে, শুরু করি খাওয়া। এরপরে ক্লাশের ফাঁকে ফাঁকে, বাসায় ফিরে রাস্তায় চায়ের দোকানে, আমার নিজের ড্রাইভার এর সাথে, এইভাবে সিগারেট খেতে খেতে এক সময় দেখি বাসায় ফেরার সময় ৩-৪ টা করে সিগারেট কিনে বাসায় ফিরি। তখনই বুঝতে শুরু করেছিলাম যে আমি যা করছি সেইটা ঠিক করছি না, কিন্তু নিজেকে বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে, এই সিগারেট খাওয়া আমি চাইলেই ছাড়তে পারব, এইটা কোন বড় ইস্যু না। এইটা জাস্ট আমি ভালো লাগে বলে খাই, আমি সিগারেট এর উপর ডিপেন্ডেন্ট না।
এইভাবে আরো ৪ বছর চলে গেল। জীবনের অনেক কিছুই চেঞ্জ হয়ে গেল, কিন্তু আমি আর সিগারেট চেঞ্জ হলাম না। এক সময় এমন হত যে দেড় দিন যেত এক প্যাকেট সিগারেট এ। তখন সিগারেট এর বিল খেয়াল করতাম না। মাঝে মাঝে হিসাব করে দেখতাম এই মাসে আমার কত টাকা লাগল, তার থেকেও বড় কথা, নিজের রুমের দিকে তাকানো যেত না, ছাই, সিগারেট এর প্যাকেট এ ছড়াছড়ি। রাতে ঘুমানোর সময় প্রতিদিন চিন্তা করতাম, আজকেই আমার শেষ সিগারেট। সকালে উঠে নাশতা করার পরেই মনে হত, আচ্ছা এখন আমি কেমন করে বাকি দিন পার করব? বিকালে চা খাবার পরে একটা সিগারেট না ধরালে চলতই না। প্রেমিকার সাথে ঝগড়া, সিগারেট লাগবে। অনেক সুন্দর জোৎস্না, সিগারেট ছাড়া কেমন করে সেলিব্রেট করব? আজকে রাত জাগতে হবে, সমস্যা কি, সিগারেট আছে না।
রিহ্যাবঃ
এর মাঝে ৩-৪ বার হাফ হার্টেড চেষ্টা করেছিলাম সিগারেট ছাড়ার কিন্তু ছাড়তে পারি নাই, মনে হচ্ছিল যে এইটা কি করছি নিজের জীবন নিয়ে? আমি সিগারেট ছাড়া যেই কষ্টে আছি, এই কষ্ট ভোগ করার থেকে সিগারেট খেয়ে ২ দিন পরে মরে যাওয়া ঢের ভালো। যাই হোক, এইভাবে আরো কিছুদিন গেল। এই বছরের জানুয়ারী মাসের ১৮ তারিখের কথা। যেকোন কারনেই একদিন সিগারেট না খেয়ে ছিলাম, পরের দিন মনে হল, আমি যদি আর সিগারেট না খাই তাহলে কি হবে? গুগলে সার্চ করে অনেকগুলা লিঙ্ক খুঁজে পেলাম, আমি অনেক আগে থেকেই একটা অনলাইন ফোরাম ব্যবহার করি, রেডিট নাম। সেখানে স্পেশালাইজড সাব ফোরাম আছে, এমন একটা সাবফোরামের সন্ধান পেলাম, নাম /r/stopsmoking । এইখানে একটা বই এর খোঁজ পেলাম, ইজি ওয়ে টু স্টপ স্মোকিং। আমি কোনদিন মনে করি নাই, যে একটা বই পড়ে আমি কখনো সিগারেট খাওয়া ছাড়তে পারব, যেখানে প্রায় ৫ বছর যাবত সিগারেট খেয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমার লাইফের অন্যতম বড় মিরাকল হল এই বইটা পড়ে, আমি সাথে সাথেই সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিলাম। একবারে, আগের দিন খেয়েছিলাম ১৫ টা, তার পরের দিন একটাও না। না তো না ই। এইভাবে চলে গেল প্রায় তিন মাস।
রিল্যাপ্সঃ
অ্যালেন কার বার বার করে লিখেছিলেন যে, একবার সিগারেট ছাড়ার পরে আর যেন কোন অবস্থাতেই কখনোই সিগারেটে হাত না দেই, কিন্তু আমি তো বেশি বুঝি, সো ৮৭ দিনের দিন মনে হল, আমি আর সিগারেট পছন্দ করি না, যাই গিয়ে একটা সিগারেট ধরাই। ধরালাম, কাশতে কাশতে শেষ। এর পরে মনে হল, এমন একটা বাজে জিনিষ আমাকে কখনোই অ্যাডিক্ট করে ফেলতে পারবে না, এইটা প্রমাণ করার জন্যই যাই গিয়ে আবার খাই। কিন্তু বিধিবাম, এমন করতে করতে কখন আমি আবার অ্যাডিক্ট হয়ে গেলাম বুঝলামই না। মাত্র ১০ দিন আগে আমি দেখলাম, আমি ১৬ টা সিগারেট খেয়েছি একদিনে। নিজের কাছে এত খারাপ লাগছিল, হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করলাম। এই জিনিষ আমি এত কষ্ট করে ছেড়ে দিয়েছি, আর এখন আমিই ড্রয়ারে সিগারেট না থাকলে ইনসিকিউরড ফিল করি। প্রতিবার বাসা থেকে বের হয়ে দোকানে গিয়ে সিগারেট কেনাটাকে আমার ওয়াক অফ শেম মনে হল।
ফ্রিডমঃ
৭ দিন আগে মনে হল, অ্যালান কারকে আমার আবার দরকার, অডিবল এ লগ ইন করে পুরা বইটা আবার নামালাম, খুবই বোরিং লাগছিল শুনতে কিন্তু তাও পুরাটা এক বসায় শুনে শেষ করলাম। এবং যাদুর মত আমার মনে হল, আর খাব না সিগারেট। সেই যে সিগারেট টা ফেলে দিলাম নিজের হাত থেকে, এই পোস্ট করার সময় এক্সাক্টলি ৭ দিন হবে আমি সিগারেট না খেয়ে আছি। একটা বই পড়ে কেউ সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারে এইটা আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু অ্যালান কার এইটা আমার ক্ষেত্রে করে দেখিয়েছেন, একবার না। দুই দুইবার। আমার বিশ্বাস, কেউ যদি আসলেই সিগারেট খাওয়া ছাড়তে চায় এবং সে অ্যালান কার এর বই পড়ে, তাহলে সে আর সিগারেট খেতে পারবে না। আমি নিশ্চিত, আমি আর কোনভাবেই আর এক পাফ ও খাচ্ছি না সিগারেট।
ইজি ওয়ে টু স্টপ স্মোকিংঃ
কি আছে অ্যালান কার এর বই এ? যদি কেউ আসলে না পড়ে তাহলে এইভাবে লিখে বোঝানে কঠিন, কিন্তু সংক্ষেপে সিগারেট খাওয়া ছাড়ার সময় কিছু জিনিষ মাথায় রাখতে হবেঃ
- সিগারেট আমাদের কোন বন্ধু না, সিগারেট ছাড়তে আমাদের কষ্ট হবার কথা না। সিগারেট ছাড়া অনেক কষ্টের এইটা একটা ব্রেনওয়াশ, লোকমুখে শোনা কথা। নিকোটিন এর প্রভাব শরীরে এতই কম যে নিকোটিন কুইট করার সাইড ইফেক্ট নেই বললেই চলে। জাস্ট আমাদের মানসিক ভয়টা জয় করতে হবে।
- যারা নন স্মোকার তারা সমস্ত উৎসব, অনুষ্ঠান, বিরহ, শোক সিগারেট নামক ক্রাচ ছাড়াই পার করতে পারে। তাহলে যারা স্মোকার তাদের সেইটা লাগবে কেন?
- যারা সিগারেট খায় তারা সবাই স্বাস্থ্যের কথা জানে, ভয় দেখায়, লোভ দেখায়, পুরষ্কার এর আসা দেখায় সিগারেট খাওয়ানো বন্ধ করা যাবে না। এইটা করতে হবে বুঝায়ে যে, সিগারেট কোন সাহায্য করে না। এইটা জাস্ট একটা ক্রাচ, এইটা ড্রাগ অ্যাডিকশন।
- শেষ কথা, সিগারেট, তথা নিকোটিন এমন একটা জিনিষ, যেটা তার প্রতি অ্যাডিক্টেড মানুষকে আনন্দের সময় আরো আনন্দিত করে, দুঃখের সময় আরো দুঃখিত করে (সেইজন্যই তো একটার পর একটা খেতেই থাকে অ্যাডিক্টেড মানুষটা, দুই অকেশনেই)। আসল কথা হল, আনন্দ বা দুঃখ স্বতঃস্ফূর্ত অনুভুতি, এর সাথে সিগারেট এর কোন সম্পর্ক নাই।
এই পোস্টটার আসলে তেমন কোন উদ্দেশ্য নাই, জাস্ট আমার একটা অ্যাচিভমেন্ট শেয়ার করতে ইচ্ছা হল, সেখান থেকেই এতকিছু লেখা। যদি এতদুর পর্যন্ত পড়ে থাকেন, ধন্যবাদ।
আশাকরি এবার স্মোকিং ছাড়তে পারবো !
অবশ্যই।
অভিন্দন, মনের যুদ্ধ জয়ে বিজয়ী হবার জন্য। জয়ের ধারা অব্যাহত থাকুক 🙂
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
এই বইয়ের নাম আমিও বেশ কয়েকবার শুনেছি। একবার Hrithik Roshan তার সাক্ষাত্কারে বেশ কয়েকবার এই বইয়ের নাম বলেছে। আমার কুইট করতে কোনও বইয়ের প্রয়োজন পড়ে নাই। তবুও বইটা পড়ার খুব ইচ্ছে আছে।
ধন্যবাদ